দেশে ক্রমে বেড়ে চলেছে মাদকের কারবার। চলতি বছর জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত পাঁচ মাসে সারা দেশে প্রায় ৪২ হাজার (৪১ হাজার ৭৫৯টি) মাদকের মামলা হয়েছে। এতে আসামি করা হয়েছে ৫১ হাজার ৮৩৪ জনকে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১১ হাজার ২৩১ জনকে। গ্রেপ্তারের জন্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী খুঁজে পাচ্ছে না ৪০ হাজার ৬০৩ জনকে।
তবে গ্রেপ্তার না হওয়া মাদক কারবারিরা প্রকাশ্যে এই কারবার অব্যাহত রেখেছে। গ্রাম থেকে শহর, বর্তমানে সবখানে মাদকের বিস্তার ঘটেছে। মাদকের কারণে সন্তানদের নিয়ে অসহায় অভিভাবকরা।
মাদক নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন সময় বন্দুকযুদ্ধে চার শতাধিক মাদক কারবারি নিহত হলেও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। বরং দেশে চিহ্নিত হয়েছে মাদক চোরাচালানের অন্তত ১২টি রুট।
জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন বিষয়ক সংস্থা আংকটাডের গত ৮ জুনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মাদকের কারণে প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে ৪৮১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (প্রায় পাঁচ হাজার ১৪৭ কোটি টাকা) পাচার হয়ে যাচ্ছে।
এমন পরিস্থিতির মধ্যে আজ সোমবার (২৬ জুন) পালিত হচ্ছে ‘মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস-২০২৩’।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হিসাব মতে, বর্তমানে দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৭৫ থেকে ৮০ লাখ। মাদক নির্মূলে ২০১৮ সালের ৪ মে সারা দেশে মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযান শুরু হয়। ওই সময় মাদকাসক্তের সংখ্যা ছিল ৩০ থেকে ৩৫ লাখ।
বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে গত ১৪ জুন সচিবালয়ে আইন-শৃঙ্খলাবিষয়ক মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে মাদক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আলোচনা শেষে কমিটির সভাপতি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণাসহ সরকার নানা উদ্যোগ নিলেও মাদকসেবীর সংখ্যা কমেনি; বরং বেড়েছে।
তাই বর্তমানে মাদক পরিস্থিতি নাজুক। বিষয়টি উদ্বেগজনক। মাদকের বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধকে’ ব্যর্থ হিসেবে মেনে নিয়ে এর বিরুদ্ধে আরো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। একই সঙ্গে অভিভাবকদের সচেতনতা বাড়াতে হবে।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, বর্তমানে দেশে মাদকাসক্ত মানুষের সংখ্যা ৮০ লাখের বেশি। এর মধ্যে ৮০ শতাংশই যুবক। মোট মাদকাসক্তের মধ্যে ৪৮ শতাংশ শিক্ষিত। মাদকাসক্তদের মধ্যে ৫৭ শতাংশ যৌন অপরাধী। জেলখানায় যত মানুষ আছে, এর বেশির ভাগ মাদক পাচারকারী।
গত বছর জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর—এই এক বছরে র্যাবের বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এক বছরে সারা দেশে র্যাবের অভিযানে ১০ হাজার ৫৭৩ জন মাদক কারবারি গ্রেপ্তার হয়েছে। এর মধ্যে মাঠ পর্যায়ের মাদক কারবারি আট হাজার ৪৭৩ জন। শীর্ষ মাদক কারবারি রয়েছে ২২২ জন।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দেশে ২৫ ধরনের মাদক শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে বেশ কটি দেশে প্রবেশ করেছে গত তিন বছরে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাদকাসক্তদের মধ্যে ৯০ শতাংশ কিশোর-তরুণ। এদের ৮৫ শতাংশ ইয়াবাসেবী। এদের অনেকে আবার ইয়াবা কারবারে জড়িত।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) সর্বশেষ পরিসংখ্যান বলছে, দেশে বর্তমানে প্রায় ৩০ ধরনের মাদক সেবন করা হচ্ছে। এর মধ্যে ইয়াবা শীর্ষে। দেশে প্রতিদিন প্রায় ৭০ লাখ ইয়াবা বিক্রি হয়। এর মধ্যে রাজধানীতে বিক্রি হয় অন্তত ১৫ লাখ। প্রতিটি ইয়াবার দাম ৩০০ টাকা হলে ৭০ লাখ ইয়াবার দাম দাঁড়ায় ২১০ কোটি টাকা।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত আছে। তালিকা ধরে মাদক কারবারিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। মাদক আইনের মামলায় গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা জামিনে বেরিয়ে এসে ফের একই কারবারে জড়াচ্ছে। আবার এজাহার ও অভিযোগপত্রে ক্রটি, পর্যাপ্ত তথ্য-প্রমাণ ও সাক্ষীর অভাবে অনেক মাদক মামলার আসামি খালাস পেয়ে যাচ্ছে। মাদক কারবারিদের কঠোর সাজা হলে তাঁদের মধ্যে ভয় তৈরি হতো।
বিশ্লেষকরা বলছেন, চাহিদা ও অধিক মুনাফা—মূলত এ দুই কারণে মাদক কমছে না। চাহিদা থাকায় অধিক মুনাফার জন্য কারবারিরা মাদক আনতে বেপরোয়া। তাই প্রথমে চাহিদা কমাতে হবে। তরুণদের সচেতন করতে হবে।
Leave a Reply